মঞ্চ-অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য : আক্ষেপ-অভিমান-প্রাপ্তি
স ম্পা দ কী য়
আক্ষেপপর্ব
বক্ষ্যমান-সংখ্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করা যাক।
আমরা জানি, মঞ্চ-প্রযোজনা মূলত বর্তমান দর্শকের জন্যই সৃষ্টি ও পরিবেশন করা হয়। এবং, প্রযোজনায় অনিবার্য উপাচারের মধ্যে একমাত্র পাণ্ডুলিপি ছাড়া আর সবকিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। যেমন, নির্দেশক-ডিজাইনার-কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীর (অর্থাৎ অভিনেতৃর) সৃজনশীলতা, ইত্যাদি। কারণ একটাই। আমরা সবাই জানি, ‘থিয়েটার’ মানেই হলো, ত্রিমাত্রিক স্থান+জলজ্যান্ত অভিনেতৃ+জলজ্যান্ত দর্শক। সুতরাং কালের যাত্রায় যারা হারিয়ে যায়, তারা আর বর্তমান-‘থিয়েটার’-এর অংশ হয় না, হয়ে যায় স্মৃতি।

ছোটোবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ-টার্মিনাল আমার কাছে অনেক প্রিয় জায়গা। বাবা-মার সাথে নানুবাড়ি যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ টার্মিনালে এসে প্রথমেই ইটের ফাঁক দিয়ে দেখে নিতাম টার্মিনালে বাঁধা লঞ্চগুলিকে। দেখার পর নিশ্চিত হতাম নানুবাড়ি যাচ্ছি।
বলা হয়, অভিনয় নাকি মানুষের সহজাত এক বৃত্তি। তাই কি কৈশোরে আমরা অভিনয়-অভিনয় খেলি? নিজে যা নই, হই নি, চারপাশে এমন যাদের দেখি তেমন-তেমন হয়ে খেলি- শিক্ষক, ডাক্তার, মা-বাবা। আমাদের জিন-কোডে নাকি বহু হবার এক প্রবণতা, বাসনা থাকে। জন্মের পর যেমন-যেমন পরিবেশ-পরিস্থিতির কনডিশনে পড়ি- সেইমতো হয়ে উঠি আমরা একেকরকম। তবে ভেতরে নাকি যা কিছু হই নি তেমন হবার বাসনা সুপ্ত থাকে। বড়ো হয়ে অভিনয়কলায়, সেই বহু হবার বৃত্তিরই প্রকাশ হয়, তাতেই নাকি আনন্দ- অভিনেতৃ, দর্শকের।
নাজমা আনোয়ার, হুমায়ূন ফরীদি, খালেদ খান- বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চের শক্তিমান এই তিন শিল্পীর অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দুকথা লেখার দুঃসাহস করছি ‘থিয়েটারওয়ালা’র অনুরুদ্ধ হয়ে। তিনজনই প্রয়াত হয়েছেন অকালে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায়। দেশব্যাপী তাঁদের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা ছিল মঞ্চ-টেলিভিশন-চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে। জনপ্রিয়তা শিল্পের মাপকাঠি নয়। কিন্তু এই তিন অভিনেতৃই ছিলেন শিল্পের নিপুণ কারিগর। জনপ্রিয়তার বিচারের বাইরেও, বাংলাদেশে তাঁরা বেঁচে থাকবেন শিল্পের বিচারে। সে বেঁচে থাকা মহত্তম। আমি তাঁদের ‘শক্তিমান শিল্পী’ হিসেবে উল্লেখ করেছি শুরুতেই। এই তিনজনই মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে ‘শিল্পী’তে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বলেই আজ এবং ভবিষ্যতেও তাঁরা আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবেন।
মোহাম্মদ জাকারিয়া। তাঁর বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার সূচনাকালের সাথে জড়িত থাকার। মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, কলিম শরাফী প্রমুখ যখন ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র রাজনৈতিক বেড়াজালের বাইরে এসে নাটকের দল ‘বহুরূপী’ প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন কলিম শরাফী দলে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর তরুণ সহকর্মী মোহাম্মদ জাকারিয়াকে। প্রথম থেকেই মোহাম্মদ জাকারিয়া ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়লেন বহুরূপীতে। দলের প্রথম কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি।
ড. অজিতকুমার ঘোষ ‘বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন- নাট্যকারের হাতে নাটকের একটি-মাত্র রূপ, কিন্তু প্রয়োগকর্তা ও অভিনেতার বিভিন্নতা অনুযায়ী সেই একটি-মাত্র রূপ নানা বিচিত্ররূপে দেখা যায়, নাট্যকারের সৃষ্টি নবনবতর সৃষ্টি হয়ে ওঠে মঞ্চে। অভিনেতার আকৃতি, প্রকৃতি ও প্রবণতা অনুযায়ী একই চরিত্র নতুন নতুন তাৎপর্য, সম্ভাবনা ও ভাবরসে মূর্ত হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গ বিবেচনা : পরিচয়
১
করোনার আগে থেকেই ঢাকার বাইরে, তাতে অভাববোধ তেমন ছিল না। তবে খবর তো জানতাম, চোখে পড়ে- নতুন নতুন দলের নাটক বেশ হচ্ছে, দেশি-বিদেশি সাহিত্য নিয়ে হচ্ছে, ভালোই বলছে অনেকে। তার ফলে স্বভাবের মুদ্রাদোষে এসব দেখার একটা বাসনা জন্মায়। সুযোগ ঘটায় একটি নাটক দেখার দাবি- একটানা সপ্তাহখানেক হবে। তখনই বেশ কটি নাটক পরপর দেখি। তার মধ্যে চারটি নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে, যারা কেবল দ্রষ্টব্য নয় দিশারিও। তাই- দ্রষ্টা নাট্য-চতুষ্টয়। এগুলোর নবভাবন ও রূপায়ণ-ভিন্নতায় লেখাও নানারকম হলো, ভেবে বুঝে আগে থেকে ঠিক করা নয়।
অভিনয়তন্ত্র এক হারিয়ে যাওয়া বর্ণমালা।
‘তুমি ও আমি দৃশ্য, শ্রাব্য, স্পর্শনীয় এই মুহূর্তে, এই দ্বারকায়। কিন্তু দ্যাখো, এই মুহূর্ত এইমাত্র অন্য এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, অন্য এক মুহূর্তে আবার। সঙ্গে নেয় তোমাকে আমাকে টেনে, টেনে নেয় দৃষ্টি, শ্রুতি, ঘ্রাণ, বৃক্ষ, জন্তু, নক্ষত্র, নিখিলবিশ্ব।- সংলাপগুলো বুদ্ধদেব বসুর নাটক কালসন্ধ্যা থেকে নেয়া। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ এর হয়ে আমি ‘ব্যাসদেব’ চরিত্রে এগুলো উচ্চারণ করতাম মঞ্চে। আজ থেকে প্রায় বিশ/একুশ বছর আগে।
মোহাম্মদ জাকারিয়া তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে এসেছিলেন গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি প্রখ্যাত নাট্যবোদ্ধা শম্ভু মিত্রের ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে কাজ করতেন। শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে ‘বহুরূপী’র প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যও ছিলেন তিনি। সেই সময়ে তিনি দার্শনিক-অভিনেতা মহর্ষি মনোরঞ্জনের সাহচার্যে আসতে পেরেছিলেন। তার সহকর্মীরা ছিলেন তৃপ্তি মিত্র, মোহাম্মদ ইস্রাফিল, কুমার রায়, কলিম শরাফী, সুবিতাবৃত্ত দত্ত এবং আরো অনেকে।
মঞ্চে চলছে নাট্যাভিনয়। অন্ধকার মঞ্চে গভীর মনোযোগ দিয়ে অভিনয় দেখছেন দর্শকবৃন্দ। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে নানারকম অনুভূতির শব্দ। কখনো মৃদু, কখনো উচ্চশব্দে। কখনো-বা উচ্চহাসি আর হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠছে অন্ধকার-মঞ্চ। একসময় নাটক শেষ হয়। দর্শক বেরিয়ে যান গ্যালারি থেকে, যুক্ত হন দৈনন্দিন কাজে। এক-দুইঘণ্টার অভিনয়কাণ্ডের পর নাটক কোথায় যায়?
মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের কুশলী ও জনপ্রিয় অভিনেতা প্রয়াত নট হুমায়ূন ফরীদি।
সৈয়দ শামসুল হকের ঈর্ষা নাটকের তিনটি চরিত্র। প্রৌঢ়, যুবতী আর যুবক। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এই নাটকটিতে মাত্র সাতটি সংলাপ। নাটকের ব্যাপ্তি ২ ঘণ্টার অধিক। মাত্র তিনজন চরিত্র বলবেন সাতটি বিশাল সংলাপ। প্রৌঢ় চরিত্রে জামালউদ্দিন হোসেন, যুবতী চরিত্রে সারা যাকের আর যুবক চরিত্রে খালেদ খান। আহা! কী অসাধারণ কেমিস্ট্রি দেখেছিলাম তিনজনের সংলাপে!
নাট্যকলা চলমান এক শিল্পমাধ্যম। দীর্ঘদিনের বাহিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনারভিত্তিতে তার গতি-প্রকৃতি আবর্তমান। হুটকরেই তার রূপ-রেখা বদলায় না। শিল্পাদর্শ ও দর্শকের রসভস্বাদনের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক-প্রক্রিয়ায় নাট্যচর্চার রীতি-প্রকৃতি ও প্রবণতা তৈরি হয়। বাঙালির নাট্য-সংস্কৃতি হাজার বছরের নানা চড়াই-উৎরাই, আন্দোলন-প্রতিঘাত, দেশজ-বিদেশি নানা জ্ঞান-তর্কের মাধ্যমে আজকের দিনের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহী নাট্যচর্চা সমকালীন বিশ্বনান্দনিকতায় বিকাশের পথ সৃষ্টি করেছে।